ভারত বর্তমানে ১০০’র বেশি দেশে প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম রপ্তানি করছে বলে জানা গিয়েছে দেশটির বার্ষিক প্রতিরক্ষা প্রতিবেদনে।
প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে আত্মনির্ভরতার পথে এক উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ হিসেবে গুজরাটের ভাদোদারায় ২৮ অক্টোবর, ২০২৪ তারিখে সি-২৯৫ বিমানের চূড়ান্ত সংযোজন কারখানা উদ্বোধনের মাধ্যমে ভারতের অভ্যন্তরীণ সামরিক উৎপাদনের একটি মাইলফলক অর্জিত হয়েছে।

বিমান খাতে "মেক ইন ইন্ডিয়া" উদ্যোগের একটি প্রতীক হিসেবে, টাটা অ্যাডভান্সড সিস্টেমস লিমিটেড (টিএএসএল) এবং স্পেনের এয়ারবাসের সহযোগিতায় এই কারখানাটি স্থাপন করা হয়েছে। এটি ভারতে বেসরকারি খাতে প্রথম চূড়ান্ত সংযোজন কারখানা, যা সামরিক পরিবহন বিমান সি-২৯৫ এর উৎপাদনের জন্য নিবেদিত।

এই প্রকল্পের আওতায় ৫৬টি বিমান সরবরাহ করা হবে, যার মধ্যে ১৬টি স্পেনে এয়ারবাস দ্বারা প্রস্তুত করা হবে (এর মধ্যে ছয়টি ইতোমধ্যে ভারতীয় বিমান বাহিনীর কাছে পৌঁছেছে), এবং বাকি ৪০টি বিমান স্থানীয়ভাবে তৈরি করা হবে। এই উদ্যোগটি ভারতের প্রতিরক্ষা শিল্পকে শক্তিশালী করতে এবং বিদেশি আমদানির উপর নির্ভরতা কমাতে ভারতের প্রচেষ্টাকে প্রতিফলিত করে।

সরকারের প্রতিরক্ষা উৎপাদন সক্ষমতা বৃদ্ধির প্রতি অঙ্গীকার ভারতকে একটি প্রধান অস্ত্র আমদানিকারক দেশ থেকে একটি উদীয়মান স্বয়ংসম্পূর্ণ প্রতিরক্ষা উৎপাদন কেন্দ্র হিসেবে রূপান্তর করেছে। এই পরিবর্তন ভারতের কৌশলগত লক্ষ্যের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ, যা আত্মনির্ভরতার মাধ্যমে জাতীয় নিরাপত্তা জোরদার করে তুলতে উদ্দিষ্ট।

ভারতের প্রতিরক্ষা উৎপাদনের উত্থান
আত্মনির্ভর ভারতের উদ্যোগের অধীনে, ভারতীয় প্রতিরক্ষা উৎপাদনের উত্থান একটি রূপান্তরমূলক পরিবর্তন নির্দেশ করে। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে প্রতিরক্ষা উৎপাদন ₹১,২৭,২৬৫ কোটি পর্যন্ত পৌঁছেছে, যা ২০১৪-১৫ সালে ₹৪৬,৪২৯ কোটি থেকে ১৭৪% বৃদ্ধি। এই সাফল্য সরকারের নীতি এবং দেশের প্রতিরক্ষা শিল্পকে শক্তিশালী করার প্রতিশ্রুতির ফলাফলকে প্রতিফলিত করে।

ঐতিহাসিকভাবে, ভারতের প্রতিরক্ষা খাত প্রায় ৬৫-৭০% বিদেশি উৎসের উপর নির্ভরশীল ছিল। বর্তমানে, প্রায় ৬৫% প্রতিরক্ষা প্রয়োজনীয়তা অভ্যন্তরীণভাবে মেটানো হচ্ছে, যা ভারতের প্রতিরক্ষা উৎপাদন খাতের স্থিতিশীলতাকে প্রতিফলিত করে। এই বৃদ্ধি ১৬টি প্রতিরক্ষা পাবলিক সেক্টর ইউনিট (ডিপিএসইউ), ৪৩০টিরও বেশি লাইসেন্সপ্রাপ্ত বেসরকারি কোম্পানি এবং দেশজুড়ে প্রায় ১৬,০০০ ক্ষুদ্র, ছোট এবং মাঝারি আকারের শিল্প (এমএসএমই) দ্বারা চালিত। এছাড়া, বেসরকারি খাতের উৎপাদনের ২১% অবদান আত্মনির্ভরতার পথে ভারতের অগ্রযাত্রা আরও ত্বরান্বিত করছে।

প্রতিরক্ষা রপ্তানির উত্থান
ভারতের প্রতিরক্ষা রপ্তানি অতুলনীয় মাত্রায় বৃদ্ধি পেয়েছে, যা ২০১৩-১৪ সালে ₹৬৮৬ কোটি থেকে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ₹২১,০৮৩ কোটি পর্যন্ত পৌঁছেছে। এই দশ বছরে ৩০ গুণ বৃদ্ধি আত্মনির্ভরতার উদ্যোগ, সরকারী নীতি সংস্কার, এবং সহজলভ্য ব্যবসা প্রক্রিয়ার সফলতা প্রমাণ করে। পূর্ববর্তী অর্থবছরের তুলনায় ৩২.৫% বৃদ্ধির ফলে প্রতিরক্ষা রপ্তানি নতুন উচ্চতায় পৌঁছেছে। ভারতের রপ্তানি পণ্যের মধ্যে বুলেটপ্রুফ জ্যাকেট, চেতক হেলিকপ্টার, হালকা টর্পেডো এবং দ্রুতগামী ইন্টারসেপ্টর বোট উল্লেখযোগ্য।

ভারতের সাম্প্রতিক রপ্তানির হাইলাইটের মধ্যে 'মেড ইন বিহার' বুট রয়েছে, যা বর্তমানে রাশিয়ান সেনাবাহিনী ব্যবহার করছে। বর্তমানে, ভারত ১০০টিরও বেশি দেশে প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম রপ্তানি করে, যেখানে ২০২৩-২৪ সালে শীর্ষ গন্তব্য ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স এবং আর্মেনিয়া। ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী শ্রী রাজনাথ সিং ২০২৯ সালের মধ্যে ₹৫০,০০০ কোটি রপ্তানি লক্ষ্যে পৌঁছানোর উচ্চাকাঙ্ক্ষী লক্ষ্য স্থির করেছেন।

মূল সরকারি উদ্যোগ
ভারতের প্রতিরক্ষা উৎপাদন সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগ গৃহীত হয়েছে। নীচে এই রূপান্তরমূলক নীতিগুলি উল্লেখ করা হলো:

এফডিআই নীতি শিথিলকরণ: ২০২০ সালে সরকার নতুন লাইসেন্সের জন্য প্রতিরক্ষা খাতে এফডিআই সীমা ৭৪% করেছে এবং প্রযুক্তিনির্ভর প্রকল্পগুলির জন্য সরকারী রুটে ১০০% পর্যন্ত অনুমোদিত।

বাজেট বরাদ্দ বৃদ্ধি: ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জন্য প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের জন্য ₹৬,২১,৯৪০.৮৫ কোটি বরাদ্দ করা হয়েছে, যা প্রতিরক্ষা উৎপাদন বৃদ্ধি ও সশস্ত্র বাহিনী আধুনিকীকরণে সরকারের ফোকাস নির্দেশ করে।

ইতিবাচক স্বদেশায়ন তালিকা: সরকারের পক্ষে ৫০৯টি সেবা ও ডিপিএসইউর জন্য ৫,০১২টি আইটেমের ইতিবাচক স্বদেশায়ন তালিকা প্রকাশিত হয়েছে, যা আমদানির উপর নির্ভরতা কমানোর প্রতিশ্রুতি প্রদান করে।

আইডেক্স স্কিম: উদ্ভাবনের জন্য প্রতিরক্ষা উৎকর্ষ স্কিম চালু করা হয়েছে, যা স্টার্টআপ এবং এমএসএমইগুলোকে প্রতিরক্ষা উদ্ভাবনে অংশগ্রহণ করতে উৎসাহিত করে।

পাবলিক প্রকিউরমেন্ট পছন্দ: ২০১৭ সালের পাবলিক প্রকিউরমেন্ট অর্ডারটি স্থানীয় উৎপাদনকারীদের অগ্রাধিকার দিতে প্রয়োগ করা হয়েছে, যা স্থানীয় শিল্প ও এমএসএমইগুলোকে সহায়তা করে।

প্রতিরক্ষা শিল্প করিডোর: আঞ্চলিক উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য উত্তর প্রদেশ ও তামিলনাড়ুতে দুটি প্রতিরক্ষা শিল্প করিডোর স্থাপন করা হয়েছে, যা ভারতকে একটি বৈশ্বিক প্রতিরক্ষা উৎপাদন কেন্দ্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে সহায়ক।

প্রতিরক্ষা গবেষণা ও উন্নয়ন খোলার উদ্যোগ: সরকার প্রতিরক্ষা গবেষণা ও উন্নয়নে বেসরকারি শিল্প এবং স্টার্টআপগুলোকে অন্তর্ভুক্ত করেছে, যা প্রতিরক্ষায় প্রযুক্তিগত উৎকর্ষতা বৃদ্ধি করে।

আত্মনির্ভরতার পথে ভারতের যাত্রা প্রতিরক্ষা আমদানির উপর নির্ভরতা থেকে একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ প্রতিরক্ষা উৎপাদন ক্ষমতায় পরিণত হওয়ার দিক নির্দেশ করে। দেশীয় উৎপাদন ও রপ্তানিতে রেকর্ড অর্জন জাতীয় নিরাপত্তা এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি শক্তিশালী করার প্রতি সরকারের প্রতিশ্রুতিকে তুলে ধরে।

স্বদেশায়ন, বিনিয়োগ, এবং উদ্ভাবন কেন্দ্রীক নীতির মাধ্যমে, ভারত তার নিরাপত্তার চাহিদা পূরণের পাশাপাশি বৈশ্বিক প্রতিরক্ষা সহযোগী হিসেবে উদীয়মান হচ্ছে। প্রতিরক্ষা সক্ষমতার ক্রমাগত বিকাশের মাধ্যমে ভারতের বৈশ্বিক প্রতিরক্ষা উৎপাদন খাতে শক্তিশালী অবস্থান আরও মজবুত হয়ে উঠছে, যা জাতীয় স্থিতিশীলতা এবং আন্তর্জাতিক সহযোগিতার প্রতি তার প্রতিশ্রুতি আরও জোরদার করে তুলেছে। সূত্র: ইন্ডিয়া নিউজ নেটওয়ার্ক